‘জল ভালা ভাসা, মানুষ ভালা চাষা’ স্লোগানে নেত্রকোণায় খনার মেলা

- আপডেট সময় : ১১:১৫:১৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫ ৮২ বার পড়া হয়েছে

‘জল ভালা ভাসা, মানুষ ভালা চাষা’এই প্রতিপাদ্যে নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলায় টানা দ্বিতীয়বারে মতো খনার মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে । গ্রামীণ জনসংস্কৃতি ও কৃষিতে খনার বচনের তাৎপর্য তুলে ধরে মেলায় নানা পরিবেশনা তুলে ধরা হয়।
কেন্দুয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম আঙ্গারোয়া। যেখানে ভোরের আলো ফোটার আগে রাস্তায় যেতে যেতে সামনে পড়বে হাজার হাজার ঘুঘু পাখি। যা দেখে চোখ জুড়াবে সবার। আঙ্গারোয়ার একটি বাড়ির আঙিনায় চৈত্র সংক্রান্তিতে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ভোরের হাওয়ায় উদ্বোধন হয় খনার মেলা।
রোববার (১৩ এপ্রিল) মঙ্গলঘর পরিসর আয়োজিত এই মেলা উদ্বোধনের পর মেলা মঞ্চে খনার বচন গানে গানে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। পালাগান, গীত, বাউল গানসহ নানা লোক সংগীতের বিভিন্ন ধারার পরিবেশনায় মুগ্ধতা ছড়ায় দর্শক-শ্রোতাদের মাঝে। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয় ঝড়-বৃষ্টি। বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করেই চলে অনুষ্ঠান। কৃষির লোকায়ত নানা উপকরণ দিয়ে মঞ্চ সাজানো হয়। সারাদিন ও রাতভর লোকায়ত গানের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে আগামীকাল নবর্ষের সূর্যোদয়ে ভোরের হাওয়ায় শেষ হবে খনার মেলা।
খনার মেলায় আসা মনপুরা চলচ্চিত্রের ‘যাও পাখি বলো তারে’ গানের শিল্পী কৃষ্ণকলি ইসলাম বলেন,
এটা আসলে শুধু যে একটা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড তা না। আমার কাছে মনে হয়েছে আসলে খনা তো শুধু একজন চরিত্র না। তিনি একটা অঞ্চলের, জলবায়ুর, মাটি, প্রকৃতি, মানুষ, তাদের জীবন-যাপন সব কিছু প্রকাশ করেন তার বচনের মাধ্যমে। আমি মনে করি আমার বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একটা ভয়ানক সাংস্কৃতিক সংকট চলছে। এটা এমন নয় যে পাঁচই আগস্টের পরে এটা হয়েছে। আসলে বরাবরই আমাদের এখানে উপর্যুপরি সাংস্কৃতিক সংকট তৈরি করে রাখা হয় বিভিন্ন কায়দায়। আমরা সর্বদাই চেষ্টা করে আসছি এ সংকটগুলো কাটিয়ে আমাদের সক্রিয় সংস্কৃতি চর্চা করার।
ঢাকা থেকে আসা লেখক পাভেল পার্থ বলেন, ‘জল ভাল ভাসা, মানুষ ভালা চাষা’ খনার এই বচনকে প্রতিপাদ্য রেখে এ মেলা আয়োজিত হয়েছে। এই মেলা বার্তা দেয় যে, আমাদের যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটা পৃথিবী। আমাদের যে কৃষি এখন চলছে, যে কৃষি আসলে আমাদের প্রকৃতির জন্য, মানুষের জন্য টিকে থাকার মতো থাকছে না। যেখানে এই খনার মেলা আয়োজন করা হয়েছে এখানে যে পাটেশ্বরী নদী রয়েছে, যেটি ব্রহ্মপুত্রের একটি প্রধান ধারা। সে নদীটিকে কিন্তু আমরা খুন করে ফেলেছি। একই সাথে এই অঞ্চলের ধান যেমন বদ্ধিরাজ, পিঁপড়ার চোখ বা এ রকম ধানগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।
ঢাকা থেকে আসা কবি লোকমা সৃজন বলেন, খনার ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি তিনি একজন বুদ্ধিমতি নারী ছিলেন। কিন্তু তিনি নিপীড়িত হয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। এতে বোঝা যায় যে বাংলাদেশের সমাজ আমাদের নারীদের উৎসাহিত করে না, আমাদের নারীদের নিপীড়ন করে। তার বুদ্ধি, তার জ্ঞানকে স্থান দিতে চায় না। তার একটা সিম্বল হচ্ছে খনা।
আয়োজকরা জানান, মেলা মঞ্চে সারা দিন ও রাতে খনার বচন গানে, কবিতায়, আলোচনায় পরিবেশনা চলবে। কৃষি, প্রকৃতি ও জলবায়ু সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, প্রাণ প্রকৃতিকে ভালোবাসা, এতে উজ্জীবিত হওয়া ও কৃষিতে খনার জ্ঞান ছড়িয়ে দিতেই মেলার আয়োজন করা হয়েছে।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও মঙ্গলঘর পরিসরের সদস্য কফিল আহমেদ বলেন, খনার বচন থেকে আমরা পাই ‘চৈত্রে লতা, বৈশাখে পাতা’ অর্থাৎ এই প্রাণ প্রকৃতিতে যদি চৈত্রে লতা না জন্মায় তাহলে বৈশাখে পাতা জন্মাবে না। সংক্রান্তি ও বৈশাখের জীবনের সাথে যে সংযোগ, যে পরম্পরা এটা আমরা হারিয়ে ফেলছি। বর্তমানে বিশ্ব বাস্তবতায় দেখতে পাচ্ছি মানব সৃষ্ট চিতা। যা এই পৃথিবীকে, জীবনকে ছারখার করে দিচ্ছে। জীবন-প্রকৃতিকে ছারখার করে চিতায় পরিণত করেছি আমরা। মানবসৃষ্ট চিতায় আমরা জ্বলছি।
তিনি বলেন, খনার মেলাটা আসলে মানুষের সাথে মানুষের কথা বলার মেলা, দেখা হওয়ার মেলা। কারণ জীবন বাস্তবতায় আসলে মানুষের সাথে মানুষের দেখা হওয়ার সময়-সুযোগ খুবই কম মিলছে। মানুষ শুধু মানুষ থেকে দূরে নয়, গোটা জীবন-প্রকৃতি থেকে দূরে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে।
মঙ্গলঘর পরিসরের সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, খনা হচ্ছে নারী শক্তির প্রতীক। মুক্তভাবে, স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারা, বিশ্লেষণ করতে পারা, ভবিষ্যৎবাণী করতে পারা। খনা অসম্ভব ক্ষমতা নিয়ে দুনিয়াতে এসেছিলেন এবং এটার জন্য তার শ্বশুর এবং স্বামীর প্রতিহিংসার শিকার হন। তার জ্ঞান চর্চা থামিয়ে দেওয়ার জন্য তার জিভ কেটে দেওয়া হয়। আমাদের যে কৃষককূল আছে তারা যে কৃষি চর্চা করে, এটা এখন পর্যন্ত খনার জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল। খনার বিভিন্ন বচন আছে যা বেশিরভাগই কৃষি কেন্দ্রিক। ফলে আমাদের যে বাংলার কৃষি-কৃষ্টি, নিজস্ব সংস্কৃতি, এই সংস্কৃতির বড় একটা শক্তির জায়গা হচ্ছে খনা। সেই জায়গা থেকে আমরা খনার মেলাটি আয়োজন করি। গতবার প্রথম হয়েছে, এবার দ্বিতীয়বারের মতো আয়োজন করা হয়েছে। এখানে সারাদেশ এবং দেশের বাইরে থেকে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, আগ্রহীরা আসেন।
শালবনবার্তা২৪.কম/এআর