তপ্ত দুপুরে শ্রান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে বন্ধুরা মিলে ঘরের এক কোনে বসে পাঠচক্র করছি। ভ্যাপসা গরম আর ঘামে একাকার ইলেক্ট্রিসিটি নেই তাই ফ্যান ঘুরছে না। সূর্য খাড়াভাবে মাথার উপর তা দিচ্ছে। এমন সময় এক স্বেচ্ছাসেবী ভাই মুহাম্মদ ইমরান বুলবুলকে জানালো এক বৃদ্ধা রক্তশূণ্যতা রোগীর জন্য (ও পজিটিভ) রক্তের প্রয়োজন। বুলবুল কালবিলম্ব না করে রাজী হয়ে গেলেন। তাৎক্ষণিকভাবে মধুপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে কাঙ্ক্ষিত ক্লিনিকে পৌছালেন। গিয়ে দেখতে পেলাম এক অসহায় বৃদ্ধা জীর্ণশীর্ণ অবস্থা প্রায় তার স্ত্রী সমেত বসে আছে। ভারী অসুস্থ সেই সাথে বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছে। রক্ত শূন্যতায় কাবু হিমোগ্লোবিন খুবই কম। অতপর যথারীতি ব্লাড গ্রুপ নির্ণয় ও ক্রস মেসিং সম্পন্ন হলো। এরপর বুলবুলের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করে তাৎক্ষণিক বৃদ্ধ মুরুব্বিকে পাশের বেডে শুইয়ে রক্ত প্রদান করা হলো। এমন সময় তার আত্মীয় স্বজন যারা ক্লিনিকে উপস্থিত ছিলো তাদের মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে গেলো। তারা বুলবুলের কাছে এসে সুখ দুঃখের কথা বলতে লাগলো। রক্ত সংগ্রহের জন্য তাদের কত প্রচেষ্টা ছিলো তা অন্তহীন। খুবই আবেগঘন চাহনিতে ও স্বাচ্ছন্দ্যে বুলবুলের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক খোঁজ খবর নিলেন। পরিশেষে বুলবুলের জন্য দোয়া করতে ভুললেন না।
এমন হাজারোও সাফল্যের গল্প তৈরী করেছেন মধুপুর উপজেলার স্বেচ্ছাসেবী ভাই ও বোনেরা। তাদের নিরলস প্রচেষ্টায় রক্ত দানে হাজারোও রোগী ফিরে পেয়েছেন নতুন জীবন। শুরুটা ২০১১ সালের দিকে যখন মধুপুরে "মধুপুর জেলা চাই" আন্দোলন তুঙ্গে তখন থেকেই মানবিক কাজে এগিয়ে আসেন মুষ্টিমেয় কিছু ভাই। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তৈরী হয় "মধুপুরবাসী গ্রুপ"। এক যুগ পেরিয়ে সমানতালে মানবতার পাশে মধুপুরবাসী গ্রুপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। রক্ত দানের পাশাপাশি যেকোন মানবিক সহায়তায় সবার আগে এগিয়ে এসেছে মধুপুরবাসী। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে মধুপুরে মানবিক কাজ গতিশীল হয়েছে। ধারাবাহিকতায় এগিয়ে আসেন আলোকিত মধুপুর। যাদের নিরলস প্রচেষ্টায় মধুপুরের আনাচে-কানাচে মানবিকতার আলো প্রজ্বলিত হয়। রক্ত দানের পাশাপাশি দুস্থ ও অতিসয় দরিদ্রদের পূর্নবাসন বা ইভেন্ট পরিচালনা করে আলোকিত মধুপুর। মানবিকতায় অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সংগঠনটি। সাম্প্রতিক সময়ে মধুপুরের পরিবহন সেবার মানোন্নয়নের জন্য কাজ করছে আলোকিত মধুপুর। এই সমস্ত সেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো মুলত স্কুল ও কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত। বিনামূল্যে রক্ত দানে মধুপুরে দিগন্ত উন্মোচন করেছে হৃদয়ে মধুপুর ব্লাড সোসাইটি। মহামারী করোনার প্রাদুর্ভাব যখন কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে এসেছে ঠিক সেই সময়টাতে ২০২১ সালে ৩ রা আগস্ট তরুণ ও উদ্যোমী শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাত্রা শুরু হয় হৃদয়ে মধুপুর ব্লাড সোসাইটি। যদিও তাদের রক্ত দানের যাত্রা শুরু হয় আরও আগে থেকে। শুরুর সময়টাতে রক্ত দানের জন্য মধুপুরের বাহিরেও তাদের স্বাতন্ত্র্য উপস্থিতি ছিলো। সূদুর রাজধানী কিংবা ময়মনসিংহে ডোনার নিয়ে পৌছে যেত সংগঠনটির সদস্যরা। এখনো এর ধারাবাহিকতা বিরাজমান। তবে সংগঠনটি মধুপুর কেন্দ্রিক কিছুটা গতিশীল। রক্ত দানে যে মানসিক প্রশান্তি! এই অনূভুতিটাই সংগঠনের সদস্যদের কাছে বিশেষ পাওয়া। এখন পর্যন্ত দুই সহস্রাধিক ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সংগঠনটি। সময় মতো রক্ত সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে রক্ত ডোনেট করা পর্যন্ত প্রক্রিয়ায় নিরলসভাবে কাজ করে অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে হৃদয়ে মধুপুর ব্লাড সোসাইটি।
রক্ত দান সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে নবদিগন্ত ব্লাড গ্রুপের সভাপতি সাইফুল্লাহ বিন মানসুর বলেন, রক্ত দান একটি মহৎ কাজ। দেশে রক্তের অভাবে অনেক রোগী মৃত্যুবরণ করেন। তবে আশার কথা ইদানীং তরুণরা স্বেচ্ছায় রক্তদানের জন্য এগিয়ে আসছে। যা ইতিবাচক। মধুপুরে নবদিগন্ত ব্লাড গ্রুপ ছাড়াও বেশকিছু সংগঠন স্বেচ্ছায় রক্তদান ও রক্তদানকে উৎসাহ প্রদানের পাশাপাশি বিভিন্ন মানবিক ও সেবামূলক কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহাসিকভাবেই মানবিক। তারা যুগে যুগে মানবতার তরে অসংখ্য নজির স্থাপন করেছে।সেইদিক থেকে বাংলাদেশের তরুণরা এগিয়ে। তরুণ সমাজ সকল কুসংস্কার থেকে সচেতন হয়ে রক্তদান ও সেবামূলক কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখে যাচ্ছে। এ সম্পর্কে হৃদয়ে মধুপুর ব্লাড সোসাইটি'র উদ্যোক্তা ও বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আরশেদ আলম বলেন, দুনিয়া সবচেয়ে হিংসার জায়গা মানবিক সংগঠন গুলো আমাদের উচিত একে অপরের প্রতি হিংসা না করে প্রতিযোগী হওয়া এতে মানুষের উপকার হবে৷ মানবিক কাজ শুরু হয় ২০১৪ তে তবে পরবর্তীতে রক্তদানের কার্যক্রম বৃদ্ধির লক্ষে ১০-১২ জন বন্ধু নিয়ে ২০২১ সালের ৩ আগষ্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে ক্রিয়েট করে হৃদয়ে মধুপুর ব্লাড সোসাইটি গ্রুপ৷ ধীরে ধীরে সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি তা বাড়তে বাড়তে পুরোদস্তর সংগঠনটি দাড়িয়ে যায়৷ তবে কাজটা মুটেও সহজ ছিলনা কাজটা করতে গিয়ে পরিবার ও অসাধু মানুষের বাধার মুখে পড়তে হয়েছে৷ তবে কোন বাধাই দমে রাখতে পারেনি । উল্টো এখন তরুণদের রক্তদানে উৎসাহিত করা হয় পরিবার থেকে। পরিবার ও বন্ধুস্বজন যাঁরা আগে কখনো রক্ত দেননি, তাঁরাও তিন মাস পরপর রক্তদানে উৎসাহিত হচ্ছেন। যা আশা জাগানিয়া। স্বপ্ন আছে আমাদের মধুপুর সাংগঠনটির মাধ্যমে একটা ব্লাড ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার৷ দুঃসময় অসহায় মানুষ গুলো যাতে সহজেই রক্ত পেতে পারে৷
বর্তমানে মধুপুরে স্বেচ্ছাসেবামুলক কাজ করছে বেশ কিছু সংগঠন যাদের কোন ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়া নেই নিরেট মানবিক মূল্যবোধ থেকে মানবিকতার পাশে তাদের অবস্থান। স্বপ্ন বুনন, নবদিগন্ত ব্লাড গ্রুপ মধুপুর, রক্তের বন্ধন মধুপুর, মধুপুর নাগরিক উন্নয়ন ফোরাম, সিংগারবাড়ী নবজাগরণ সমাজ সেবা সংঘ প্রমুখ সংগঠন মানবিকতার পাশে সর্বদা বিরাজমান।
লেখকঃ-
খন্দকার বদিউজ্জামান বুলবুল
শিক্ষার্থী, আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ