একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বরের ২/১ দিন আগে প্রগতিশীল ও স্বাধীনতাপ্রিয় মুহাম্মদ আখতারকে তাঁর ঢাকার পল্টনের বাসা থেকে আলবদররা ধরে নিয়ে যায়। ১৮ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবী অনেকের সঙ্গে তাঁর বিকৃত মরদেহের সন্ধান মেলে। এই মুহাম্মদ আখতার আমাদের মধুপুর অঞ্চলের একমাত্র শহীদ বুদ্ধিজীবী।১৯৯৪ সালে তৎকালীন সরকার এই বুদ্ধিজীবীর নামে ছবি সম্বলিত স্মারক ডাক টিকেট প্রকাশ করে।
মুহাম্মদ আখতারের জন্ম টাঙ্গাইলের অখন্ড মধুপুরের ধনবাড়ী গ্রামে ১৯৪০ সালের ১৯ জানুয়ারি। বাবা হাফেজ মীর মো. হাসান আলী। ১৯৫৭ সালে তাঁর স্কুলশিক্ষা সম্পন্ন হয় নিজ এলাকা ধনবাড়ীতে। এরপর ময়মনসিংহের সরকারি আনন্দমোহন কলেজে তিনি কিছুদিন পড়াশোনা করেন। ষাট দশকের মাঝামাঝি ঢাকায় এসে তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন। বিশেষ করে মুদ্রণশিল্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন দৈনিক ইত্তেফাকে প্রুপ রিডারে যোগ দিয়ে। এখানে যোগ দেওয়ার পর ঢাকার সাহিত্য মহলে তাঁর পদচারণা শুরু হয়। এ সময় তাঁর মধ্যে বাংলা বর্ণমালার সংস্কার নিয়েও ভাবনা সৃষ্টি হয়। শহীদ মুনীর চৌধুরীর বাংলা টাইপ রাইটারের সংস্কারে তাঁর ভূমিকার কথা জানা যায়। এ ব্যাপারে তিনি কয়েকটি নিবন্ধও লেখেন। কিছুদিন পর তিনি রেডিও পাকিস্তানের এলান পত্রিকার প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত হন। তাঁর যোগদানের পর পত্রিকাটি নতুন রূপ লাভ করে। সেটি পাঠক মহলে বেশ সমাদৃত হয়।
পরে মুহাম্মদ আখতার এলান পত্রিকার কাজ ছেড়ে ইস্টার্ন প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজেস লিমিটেডে যোগ দেন। এখান থেকেই প্রকাশিত হতো সাপ্তাহিক ললনা।
ললনা নারীদের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। এক সময় এ দেশের রুচিশীল নারী পাঠকের প্রশংসা পেয়েছিল। পত্রিকাটির মাধ্যমে অনেক নতুন লেখকেরও জন্ম হয়। মুহাম্মদ আখতার ছিলেন এই পত্রিকার কর্মাধ্যক্ষ। শেষ পর্যন্ত এই পত্রিকার সঙ্গেই তিনি যুক্ত ছিলেন তিনি। ললনা প্রকাশিত হতো সেগুনবাগিচার ইস্টার্ন প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজেস লিমিটেডের পক্ষ থেকে।
চিরকুমার মুহাম্মদ আখতার থাকতেন পুরানা পল্টনের একটি বাসায়। একই বাসার অন্য পাশে থাকত আরও কয়েকজন। তাদের বেশির ভাগ ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী সদস্য। তারাই মূলত স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণে আখতারকে বাসা থেকে ধরে নিতে সহায়তা করে। মুহাম্মদ আখতার ছিলেন দেশ প্রেমে উজ্জীবিত একজন মানুষ। তাঁর পরিবার গত ৫৪ বছর যাবৎ পারিবারিক মিলাদ মাহফিল করে তাঁকে স্মরণ করে যাচ্ছেন। মুহাম্মদ আখতারের ছোট ভাই মুহাম্মদ আশরাফ ধনবাড়ী কলেজিয়েট স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক। বড় ভাই সম্পর্কে তিনি জানান, দেশের জন্য নিবেদিত মুহাম্মদ আখতারকে নিয়ে তার পরিবার গর্বিত। রাষ্ট্রীয়ভাবে ১৯৯৪ সালে স্মারক ডাক টিকেট, স্মরণিকা প্রকাশ হয়েছে। এজন্য সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি জানান, ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত শহীদ পরিবারকে দেয়া ভাতা গ্রহণ করে তার সাথে পরিবার থেকে আরও অর্থ যোগ করে তাদের মা স্থানীয়দের সহযোগিতা করতেন। এখন আর সেটা চালু নেই। মীর আশরাফ আরও জানান, তাঁর বড় ভাই শহীদ বুদ্ধিজীবী মুহাম্মদ আখতার লেখালেখি করতেন। তিনি প্রবন্ধ, কবিতা লিখতেন। সাহিত্য অঙ্গণের স্মরণীয় মানুষ তিনি। তবে সব কিছু ছাপিয়ে তিনি দেশের স্বাধীনতার মুূলমন্ত্রে ছিলেন উজ্জীবিত, ছিলেন মুক্তিকামী সাচ্চা দেশ চিন্তক।
‘আমার বন্ধু’ শিরোনামে ইত্তেফাকের সৈয়দ শাহজাহান মুহাম্মদ আখতার কে নিয়ে নিবন্ধ লিখেছেন। তাতে তিনি বন্ধু মুহাম্মদ আখতার সম্পর্কে লিখেছেন, ‘২৫ মার্চের কালরাত্রি শেষে কারফিউ উঠে যাবার পর আখতার পথে নেমে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে নতুন চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হন। তখন স্বাধীনতা তার ধ্যান-জ্ঞানে পরিণত হয়। তাঁর বাসা থেকেই ভবিষ্যতের মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে যাবার দিশা পেতে শুরু করেন। এমনকি অনেককে তিনি প্রথমে নিজের বাসায় রেখে পরে কুমিল্লার রামচন্দ্রপুরের পথে আগরতলা যাবার পথ-ঘাট চিনিয়ে দেন। ঢাকার আশপাশের সংগ্রামরত মুক্তিযোদ্ধারাও আড়ালে তার বাসায় হাজির হতো। মুক্তিযুদ্ধকালে তার বাসা থেকেই অনেকে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতির খবরাখবর পেতেন।
এদিকে তার বাসারই অন্য অংশে অবস্থিত রাজাকার-আলবদরদের একটি শাখা অফিস থেকে সব সময় আখতারের গতিবিধির খবরাখবর রাখা হচ্ছে, এটা জেনেও আখতার কখনো তার কাজ থেকে বিরত হয়নি। বরং সে সময় আখতার ছিলেন অপেক্ষাকৃত বেশি সরব। তার মুখে ঝরে পড়ত রাজাকার-আলবদরদের বিরুদ্ধে বিষোদগার। একদিকে আখতারের সরব কণ্ঠ অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে তার কার্যক্রম আখতারকে রাজাকার- আলবদরদের লক্ষ্যস্থলে পরিণত করে। তাই মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের সাথে আখতারকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয় বধ্যথভূমিতে। স্বাধীনতার উষালগ্নে বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবীদের লাশের পাশে আখতারের লাশ দেখে শিউরে উঠেছিলাম।’