রক্ত দিলে কি শরীরের রক্ত কমে যায় যত ভুল ধারণা
- আপডেট সময় : ০৮:২১:৫৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৬ জানুয়ারী ২০২৫ ৮৭ বার পড়া হয়েছে
অনেকেই ভাবেন রক্ত দিলে শরীর খারাপ হয়, শরীর শুকিয়ে যায় ইত্যাদি। আসলে রক্ত দিলে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না। শরীর শুকিয়ে যায় না বা শক্তিও নিঃশেষ হয়ে যায় না। বরং রক্তদানের নানা উপকার আছে।জানাচ্ছেন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল
বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় রক্তদাতার সংখ্যা এখনো নগণ্য। দেশে বছরে ৮ থেকে ৯ লাখ ব্যাগ রক্তের চাহিদা থাকলেও রক্ত সংগ্রহ হয় ছয় থেকে সাড়ে ছয় লাখ ব্যাগ। এ ছাড়া সংগ্রহকৃত রক্তের মাত্র ৩০ শতাংশ আসে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের থেকে। নিজের পরিবারের সদস্য বা পরিচিতজন না হলে এখনো বেশির ভাগ মানুষ রক্তের জন্য নির্ভর করেন পেশাদার রক্তদাতার ওপর।
রক্তের অভাবের কারণে প্রতিবছর বহু রোগীর প্রাণ সংকটের মুখে পড়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বের ৯ কোটি ২০ লাখ মানুষ রক্ত দিয়ে থাকে। তবে উন্নত বিশ্বে স্বেচ্ছায় রক্তদানের হার প্রতি এক হাজারে ৪০ জন হলেও উন্নয়নশীল বিশ্বে প্রতি এক হাজারে চারজনেরও কম। প্রতিবছরের ১৪ জুন বিশ্ব রক্তদাতা দিবস পালিত হয়ে আসছে।
মূলত যাঁরা মানুষের জীবন বাঁচাতে স্বেচ্ছায় ও বিনা মূল্যে রক্তদান করেন তাঁদের দানের মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি দিতে, সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষকে রক্তদানে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে দিবসটি পালন করা হয়।
রক্তদানের উপকারিতা
♦ রক্তদানের মাধ্যমে আপনি অন্যের জীবন বাঁচাতে ভূমিকা রাখতে পারেন।
♦ গবেষণা বলছে, নিয়মিত রক্তদানের ফলে কিছু ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে।
♦ বছরে তিনবার রক্ত দিলে অস্থিমজ্জার রক্তকণিকা উৎপাদনব্যবস্থা আরো সক্রিয় হয় এবং নতুন লোহিত রক্তকণিকা তৈরির হার বাড়ে।
♦ যাঁদের রক্তে আয়রন জমার প্রবণতা আছে, রক্তদান তাঁদের জন্য ভালো।
♦ রক্ত দিলে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে, কখনো রক্তচাপও নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।
♦ দেহে হেপাটাইটিস বি, সি, এইচআইভি, সিফিলিস, ম্যালেরিয়ার জীবাণু আছে কি না রক্তদান উপলক্ষে বিনা খরচে অনেকেরই তা জানা হয়ে যায়।
♦ রক্ত দিলে যে ক্যালরি খরচ হয়, তা ওজন কমানোর ক্ষেত্রে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
♦ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
কারা রক্ত দিতে পারবেন
♦ ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী যেকোনো শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ও সক্ষম ব্যক্তি রক্ত দিতে পারবেন।
♦ যাঁদের ওজন ৫০ কেজি বা তাঁর বেশি (কখনো সর্বনিম্ন ওজন ৪৫ কেজিও ধরা হয়)।
♦ কোনো ব্যক্তি একবার রক্ত দেওয়ার চার মাস পর আবার রক্ত দিতে পারবেন।
কারা রক্ত দেবেন না
♦ হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম (পুরুষদের ন্যূনতম ১২ গ্রাম/ডেসিলিটার এবং নারীদের ন্যূনতম ১১ গ্রাম/ডেসিলিটার হতে হবে) থাকলে।
♦ রক্তচাপ ও শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক না থাকলে রক্ত দেওয়া ওই মুহূর্তে উচিত নয়।
♦ শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগ, যেমন হাঁপানি বা অ্যাজমা।
♦ রক্তবাহিত রোগ যেমন—হেপাটাইটিস বি বা সি, জন্ডিস, এইডস, সিফিলিস, গনোরিয়া, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি থাকলে রক্ত দেওয়া যাবে না। এ ছাড়া টাইফয়েড, ডায়াবেটিস, চর্মরোগ, বাতজ্বর, হৃদরোগ থাকলেও রক্ত দেওয়া উচিত নয়।
♦ নারীদের মধ্যে যাঁরা অন্তঃসত্ত্বা এবং যাঁদের ঋতুস্রাব চলছে তাঁরা রক্ত দেবেন না, সন্তান জন্মদানের এক বছরের মধ্যেও না।
♦ যাঁরা কিছু ওষুধ সেবন করছেন, যেমন—কেমোথেরাপি, হরমোন থেরাপি, অ্যান্টিবায়োটিক ইত্যাদি তাঁরা সে সময় রক্ত দেবেন না।
♦ যাঁদের বিগত ছয় মাসের মধ্যে বড় কোনো দুর্ঘটনা বা অস্ত্রোপচার হয়েছে, তাঁরা রক্ত দেবেন না।
রক্ত নেওয়ার আগে খেয়াল রাখতে হবে
♦ গ্রহীতার সঙ্গে দাতার রক্তের গ্রুপের অবশ্যই মিল থাকতে হবে? রক্তের চারটি গ্রুপ রয়েছে।
গ্রুপ A (+-), B (+), AB (+-) এবং O (+-)| O গ্রুপের মানুষ যেকোনো গ্রহীতাকে রক্ত দিতে পারেন। এ কারণে এই গ্রুপটিকে সর্বজনীন দাতা বলা হয়। A- গ্রুপের দাতা রক্ত দিতে পারেন A ও AB গ্রুপকে। গ্রুপ B-র দাতা রক্ত দিতে পারেন B ও AB গ্রুপকে? আর গ্রুপ AB শুধু AB গ্রুপের গ্রহীতাকেই রক্ত দিতে পারেন; যদিও বাকি সব গ্রুপ থেকে রক্ত নিতে পারে AB। এ কারণে গ্রুপ AB-কে সর্বজনীন গ্রহীতা বলা হয়। এ ছাড়া রক্তের একটি থার্ড অ্যান্টিজেন রয়েছে, যাকে RH ফ্যাক্টর বলা হয়। এই RH ফ্যাক্টর রক্তে উপস্থিত (+) থাকতে পারে অথবা অনুপস্থিত (-) থাকে। সাধারণত RH নেগেটিভ রক্ত RH নেগেটিভ রোগীর শরীরেই দেওয়া হয়। তবে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে RH পজিটিভ বা RH নেগেটিভ—যেকোনো রক্ত RH পজিটিভ রোগীকে দেওয়া যেতে পারে।
♦ কোনো রোগীকে রক্ত দেওয়ার আগে দাতা ও গ্রহীতার রক্তের কম্পোজিটের মিল হওয়াও অত্যন্ত জরুরি। গ্রুপ মেলার পরও গ্রহীতার শরীরের রক্ত যে ধরনের কম্পোজিট চায়, তার সঙ্গে দাতার রক্তের কম্পোজিটের মিল আছে কি না সেদিকে নজর রাখতে হবে।
♦ কোনো ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে রক্তের নম্বর খেয়াল রাখতে হবে। অর্থাৎ কবে সেই রক্তটি নেওয়া হয়েছিল সে বিষয়টিও খুঁটিয়ে দেখা উচিত।
♦ পাশাপাশি ব্লাড ব্যাংকের ওই রক্তের মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ অবশ্যই খেয়াল করা জরুরি। কারণ একটি নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর সেই রক্ত নিলে রোগীর শরীরে নেগেটিভ প্রভাব পড়বে।
♦ রক্তের উপাদানের রূপ অর্থাৎ কম্পোনেন্ট ফর্মও ভালো করে দেখে নিয়ে তবে ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত আনতে হবে।
♦ এক জায়গা থেকে অন্যত্র রক্ত নিয়ে যাওয়ার সময় একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বজায় রাখতে হয়? সাধারণ ২০-৬০ তাপমাত্রায় রক্ত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া উচিত।
রক্ত পরিসঞ্চালনে সাবধানতা
আমাদের দেশে ব্লাড ট্রান্সফিউশন বা রক্ত পরিসঞ্চালন বিষয়টাকে খুব হালকাভাবে দেখা হয়। দেশে হেমাটোলজিস্ট ও ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিশেষজ্ঞের সংখ্যা খুব কম হওয়ায় এসংক্রান্ত বিষয়ে আমাদের জ্ঞানচর্চাও কম। অপ্রয়োজনীয় রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রবণতা এ দেশে অনেক বেশি। আয়রন ডেফিসিয়েন্সির ক্ষেত্রে এই অপ্রয়োজনীয় রক্ত পরিসঞ্চালনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি। থ্যালাসেমিয়া ট্রেইটের ক্ষেত্রেও পাওয়া যায়। বেশির ভাগ আয়রন ডেফিসিয়েন্সিতেই রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু দেওয়া হয়। হিমোগ্লোবিন দশের নিচে নামলেই আমরা অনেকেই রক্ত দিতে আগ্রহী হয়ে উঠি।
অনেক ক্ষেত্রে ঠিকভাবে রোগ নির্ণয়ও করা হয় না। হিমোগ্লোবিন কম দেখলেই রক্ত দিয়ে দেওয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে রোগ নির্ণয় করা কিছুটা জটিল হয়ে পড়ে। গর্ভাবস্থায় আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতা খুবই সাধারণ একটি বিষয় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আয়রন সাপ্লিমেন্ট দিলে দ্রুত পূরণ হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, আমাদের দেশে এ রকম রোগীর ক্ষেত্রে রক্ত পরিসঞ্চালনের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেশি। রোগীদের মধ্যেও এজাতীয় প্রবণতা কাজ করে। হিমোগ্লোবিন কম দেখলে অনেক ক্ষেত্রে রোগীরাও অস্থির হয়ে ওঠেন রক্ত নেওয়ার জন্য।
অনিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনের কারণে হেপাটাইটিস বি, সি, সিফিলিসসহ নানা রকম ইনফেকশন হতে পারে। অ্যালার্জি থেকে শুরু করে ফুসফুসের সংক্রমণ পর্যন্ত হতে পারে। খুব বিরল হলেও গ্রাফট ভারসাস হোস্ট ডিজিজ হতে পারে।
শুনতে একটু অতিরঞ্জিত মনে হলেও সত্য যে রক্ত পরিসঞ্চালন অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মতোই একটি ঝুঁকিপূর্ণ প্রক্রিয়া। তাই রক্ত পরিসঞ্চালনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা উচিত।
সূত্র: কালের কন্ঠ