ঢাকা ০১:৫৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট ২০২৫, ৩ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বিবিয়ানা ও তিতাস গ্যাসফিল্ডে উৎপাদন হ্রাস – জ্বালানি খাতে বিপদ সংকেত

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট শালবনবার্তা২৪.কম
  • আপডেট সময় : ০৯:৪৩:২৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৭ আগস্ট ২০২৫ ১৯ বার পড়া হয়েছে

বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দেশীয় গ্যাস উৎপাদন কমেছে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট, যা জ্বালানি খাতে বড় ধরনের সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে বড় ধরনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন, অন্যথায় ভবিষ্যতে জ্বালানি খাতে ভয়াবহ সঙ্কট দেখা দিতে পারে।

পেট্রোবাংলার তথ্যানুযায়ী, দেশের দৈনিক গ্যাসের চাহিদা বর্তমানে ৫ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি। অথচ ১৩ আগস্ট পর্যন্ত সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে (এলএনজিসহ) মাত্র ২ হাজার ৮৩২ মিলিয়ন ঘনফুট। অর্থাৎ, চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বিশাল ফারাক তৈরি হয়েছে। গত বছর যেখানে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি মালিকানাধীন ২২টি গ্যাসফিল্ড থেকে গড়ে দৈনিক ১ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হতো, এ বছর তা নেমে এসেছে ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটে।

বৃহৎ গ্যাসফিল্ড তিতাসে উৎপাদন কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। ২৬টি কূপ থেকে এ বছর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে ৩১৯ মিলিয়ন ঘনফুট, যেখানে গত বছর ছিল ৩৭৮ মিলিয়ন ঘনফুট। হবিগঞ্জ গ্যাসফিল্ডে উৎপাদন নেমে এসেছে ১১৬ থেকে ৯০ মিলিয়ন ঘনফুটে, আর রশীদপুরে তা কমেছে ৬৯ থেকে ৬১ মিলিয়ন ঘনফুটে। দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসফিল্ড বিবিয়ানায়ও বড় ধস নেমেছে—গত বছর যেখানে দৈনিক উৎপাদন ছিল ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট, বর্তমানে তা ৯০০ মিলিয়নে নেমে এসেছে। জালালাবাদ গ্যাসফিল্ডেও একই প্রবণতা দেখা গেছে; উৎপাদন কমে দাঁড়িয়েছে ১৩৭ মিলিয়ন ঘনফুটে।

দেশীয় উৎপাদন কমে যাওয়ায় সরকার এলএনজি আমদানির মাধ্যমে ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করছে। বর্তমানে এলএনজি সরবরাহের সক্ষমতা ১১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। গত বছর যেখানে সরবরাহ করা হয়েছিল ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট, চলতি বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটে। তবে আমদানিনির্ভর এই ভারসাম্য সমাধান হিসেবে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়। কারণ প্রতিনিয়ত গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে, অথচ দেশীয় মজুত দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতীত সরকার দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন বৃদ্ধির বদলে আমদানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভর করেছে। বর্তমান সরকার এসে নতুন গ্যাসকূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছে, তবে সেটি সময়সাপেক্ষ। একটি গ্যাসকূপ আবিষ্কার থেকে উৎপাদনে আনতে সময় লাগে প্রায় ৩ বছর। সে কারণে তাৎক্ষণিক কোনো সমাধান পাওয়া সম্ভব নয়।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন বলেন, “গ্যাস সংকট বহুদিন ধরেই চলছে। অনুসন্ধানের বদলে আমদানিকে প্রাধান্য দেওয়াই আজকের এই পরিস্থিতির মূল কারণ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১০০টি নতুন গ্যাসকূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছে, তবে বাস্তবে এর সুফল পেতে সময় লাগবে।”

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, “আমরা এক্সপ্লোরেশনের মাধ্যমে গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছি। পাশাপাশি ওয়ার্কওভার কূপের মাধ্যমেও উৎপাদন বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে এ খাতকে স্থিতিশীল করতে দীর্ঘমেয়াদি রোডম্যাপ তৈরি জরুরি।”

বাংলাদেশের বড় গ্যাসফিল্ডগুলোর মজুত দ্রুত হ্রাস পাওয়ায় আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, যদি হঠাৎ কোনো কূপে বড় ধরনের উৎপাদন ধস নামে, তবে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়বে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের জরুরি পদক্ষেপ ও পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

error: Content is protected !!

বিবিয়ানা ও তিতাস গ্যাসফিল্ডে উৎপাদন হ্রাস – জ্বালানি খাতে বিপদ সংকেত

আপডেট সময় : ০৯:৪৩:২৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৭ আগস্ট ২০২৫

বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দেশীয় গ্যাস উৎপাদন কমেছে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট, যা জ্বালানি খাতে বড় ধরনের সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে বড় ধরনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন, অন্যথায় ভবিষ্যতে জ্বালানি খাতে ভয়াবহ সঙ্কট দেখা দিতে পারে।

পেট্রোবাংলার তথ্যানুযায়ী, দেশের দৈনিক গ্যাসের চাহিদা বর্তমানে ৫ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি। অথচ ১৩ আগস্ট পর্যন্ত সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে (এলএনজিসহ) মাত্র ২ হাজার ৮৩২ মিলিয়ন ঘনফুট। অর্থাৎ, চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বিশাল ফারাক তৈরি হয়েছে। গত বছর যেখানে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি মালিকানাধীন ২২টি গ্যাসফিল্ড থেকে গড়ে দৈনিক ১ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হতো, এ বছর তা নেমে এসেছে ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটে।

বৃহৎ গ্যাসফিল্ড তিতাসে উৎপাদন কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। ২৬টি কূপ থেকে এ বছর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে ৩১৯ মিলিয়ন ঘনফুট, যেখানে গত বছর ছিল ৩৭৮ মিলিয়ন ঘনফুট। হবিগঞ্জ গ্যাসফিল্ডে উৎপাদন নেমে এসেছে ১১৬ থেকে ৯০ মিলিয়ন ঘনফুটে, আর রশীদপুরে তা কমেছে ৬৯ থেকে ৬১ মিলিয়ন ঘনফুটে। দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসফিল্ড বিবিয়ানায়ও বড় ধস নেমেছে—গত বছর যেখানে দৈনিক উৎপাদন ছিল ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট, বর্তমানে তা ৯০০ মিলিয়নে নেমে এসেছে। জালালাবাদ গ্যাসফিল্ডেও একই প্রবণতা দেখা গেছে; উৎপাদন কমে দাঁড়িয়েছে ১৩৭ মিলিয়ন ঘনফুটে।

দেশীয় উৎপাদন কমে যাওয়ায় সরকার এলএনজি আমদানির মাধ্যমে ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করছে। বর্তমানে এলএনজি সরবরাহের সক্ষমতা ১১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। গত বছর যেখানে সরবরাহ করা হয়েছিল ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট, চলতি বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটে। তবে আমদানিনির্ভর এই ভারসাম্য সমাধান হিসেবে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়। কারণ প্রতিনিয়ত গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে, অথচ দেশীয় মজুত দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতীত সরকার দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন বৃদ্ধির বদলে আমদানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভর করেছে। বর্তমান সরকার এসে নতুন গ্যাসকূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছে, তবে সেটি সময়সাপেক্ষ। একটি গ্যাসকূপ আবিষ্কার থেকে উৎপাদনে আনতে সময় লাগে প্রায় ৩ বছর। সে কারণে তাৎক্ষণিক কোনো সমাধান পাওয়া সম্ভব নয়।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন বলেন, “গ্যাস সংকট বহুদিন ধরেই চলছে। অনুসন্ধানের বদলে আমদানিকে প্রাধান্য দেওয়াই আজকের এই পরিস্থিতির মূল কারণ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১০০টি নতুন গ্যাসকূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছে, তবে বাস্তবে এর সুফল পেতে সময় লাগবে।”

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, “আমরা এক্সপ্লোরেশনের মাধ্যমে গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছি। পাশাপাশি ওয়ার্কওভার কূপের মাধ্যমেও উৎপাদন বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে এ খাতকে স্থিতিশীল করতে দীর্ঘমেয়াদি রোডম্যাপ তৈরি জরুরি।”

বাংলাদেশের বড় গ্যাসফিল্ডগুলোর মজুত দ্রুত হ্রাস পাওয়ায় আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, যদি হঠাৎ কোনো কূপে বড় ধরনের উৎপাদন ধস নামে, তবে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়বে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের জরুরি পদক্ষেপ ও পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।