শিশুশ্রমের অভিশাপ থেকে মুক্তি কোথায় ?

- আপডেট সময় : ০৬:১৫:৩৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ মে ২০২৫ ১৩৭ বার পড়া হয়েছে

বাংলাদেশে শিশুশ্রম এক ভয়াল সামাজিক সমস্যা। যে বয়সে বাবার হাত ধরে পথ চলবে, মায়ের মমতা মাখা হাতের স্পর্শে ভালোবাসা খুঁজে বেড়াবে সে বয়সে দূঃসহ ও অমানবিক পরিশ্রম করানো হচ্ছে কমলমতি শিশুদের দিয়ে। যে বয়সে বই হাতে কিংবা স্কুল ব্যাগ কাঁধে উচ্ছ্বাস নিয়ে স্কুলে যাবে এবং শিশুদের কলতানিতে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ মুখরিত থাকবে সে বয়সে হাতে ইটের বোঝা কিংবা মাথায় মাটিপূর্ণ খাচা। যে বয়সটা ছিলো আনন্দে সময় কাটাবার সেই বয়সে অনেকেই ইটের ভাটায় ইট ভাঙা কিংবা কারখানার ঝুঁকিপূর্ণ কাজে সময় অতিবাহিত করছে। শিশুশ্রম একটি জাতির জন্য শুধু লজ্জার নয় বরং ভবিষ্যতের জন্য বড়োসড়ো হুমকি। শিশুশ্রম একটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে এবং তাদের জীবনের সম্ভাবনাগুলোকে ধ্বংস করে। সেই সাথে শিশুশ্রম শিশুদের জীবনকে দূর্বিষহ করে সুন্দর জীবনের পথ থেকে ছিটকে দিচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ অনুযায়ী, ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৩৫ লাখের বেশী শিশু কোন না কোন কাজে নিয়োজিত, যার মধ্যে ১৮ লাখ শিশু শিশুশ্রমের শিকার এবং ১০ লক্ষ ৭০ হাজার শিশু বিপজ্জনক কাজে নিয়োজিত। প্রতিনিয়ত অনেক শিশুদের দিয়ে কলকারখানার ভারী ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো সম্পন্ন করানো হয়। এতে জীবনের ঝুঁকি থাকে এবং অতন্ত্য কম বেতনে তাদের কাজে রাখা হয়। সেই সাথে অসুস্থ কিংবা কাজ করতে গিয়ে আহত হলে নূন্যতম চিকিৎসা পর্যন্ত প্রদান করা হয় না বরং অনেক সময় চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়। যে সব শিশুশ্রমিক ভারী ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সাথে জড়িত থাকে তারা প্রায়ই দূর্ঘটনার শিকার হন এবং দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতায় ভোগেন। ইটভাঙা কিংবা জাহাজ ভাঙা শিল্প, পোশাক শিল্প, কৃষিসহ বিভিন্ন সেক্টরে ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো অসহায় ও কোমলমতি শিশুদ দিয়ে করানো হয়, যা বেশ কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী ১৪ বছরের নিচে কোন শিশুকে কাজ করানো নিষিদ্ধ এবং ১৮ বছরের নিচে বিপজ্জনক কাজে নিয়োগ নিষিদ্ধ। তবে এই আইন সব খাতের জন্য প্রযোজ্য নয়। যেমন: কৃষি খামার, গৃহকর্ম এবং ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো এ আইনের আওতার বাহিরে। বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রমের সংখ্যা ১৬০ মিলিয়নে পৌঁছেছে। যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুলত অর্থনৈতিক সংকট শিশুশ্রম বৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব ফেলে। শিশুশ্রম বৃদ্ধিতে বা শিশুশ্রম তৈরীতে প্রধানত দায়ী দারিদ্র্যতা। একটি দরিদ্র পরিবারের শিশু মানে টাকা উপার্জনের একটি উৎস। অনেক পরিবার শিশুদের বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে কাজে পাঠায়। এছাড়া সামাজিক সচেতনতার অভাব ও অশিক্ষা শিশুশ্রম তৈরীতে বড় ভূমিকা পালন করে। অনেক অভিভাবক হয়তো জানে না যে, শিশুশ্রম তাঁদের সন্তানদের কতটা ক্ষতির সম্মুখীন করছে। শহরমুখী গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ঢল কিংবা শিশুদের খুব সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায় বা সস্তা শ্রমশক্তি এবং সেই সাথে আইনের যথাযথ প্রয়োগের দুর্বলতা শিশুশ্রম তৈরীতে দায়ী।
শিশুশ্রমের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা। পরিবার, সমাজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রকে একত্রে শিশুশ্রম নির্মূলে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করতে হবে এবং এজন্য রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর সুবিধা প্রধান করা যেতে পারে। শিশুদের জন্য শিক্ষার অবারিত সুযোগ, নিরাপদ শৈশব এবং স্বাভাবিক বিকাশ নিশ্চিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমরা যদি সবাই মিলে কাজ করি তাহলে একদিন শিশুশ্রমের কালো অধ্যায় থেকে রেহায় পাবো। শিশুশ্রম মুক্ত একটি সমাজ গড়ার অর্থ হলো একটি জাতীর ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করা। আর তখনই আমরা বলতে পারবো আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।
লেখক-
শিক্ষার্থী,
আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ