রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি : এক যুগেও মেলেনি বিচার

- আপডেট সময় : ০৯:০১:৪৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫ ৫৮ বার পড়া হয়েছে

আজ থেকে এক যুগ আগে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ধসে পড়েছিল সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকার রানা প্লাজা। বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমজীবী। আহত হন আরও প্রায় দুই হাজার মানুষ। ভবন ধসে বিপুলসংখ্যক মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনায় ওই সময় মোট চারটি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে অবহেলার কারণে মৃত্যু উল্লেখ করে হত্যা মামলা দায়ের করে পুলিশ, ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় একটি মামলা করে রাজউক এবং ভবন নির্মাণে দুর্নীতি ও সম্পদের তথ্য গোপন সংক্রান্ত দুটি মামলা করে দুদক। দীর্ঘ বারো বছরে চারটি মামলার মধ্যে সম্পদের তথ্য গোপনের মামলা নিষ্পত্তি হলেও বাকি তিনটি মামলা নিষ্পত্তির মুখ দেখছে না।
আসামিপক্ষ বলছে, মামলাগুলো নিষ্পত্তি না হওয়ায় বিচারহীনভাবে কারাগারে আটক রয়েছেন ভবন মালিক সোহেন রানা। অন্যদিকে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির প্রত্যাশা রাষ্ট্রপক্ষের।
রানা প্লাজার হত্যা মামলা
রানা প্লাজা ধসের পরদিন সাভার থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ ভবন নির্মাণে ‘অবহেলা ও ত্রুটিজনিত হত্যা’র অভিযোগে মামলাটি দায়ের করেন। এছাড়া রানা প্লাজা ধসে নিহত হওয়ার ঘটনাকে হত্যাকারী আখ্যায়িত করে আদালতে আরেকটি মামলা করেন গার্মেন্ট শ্রমিক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী শিউলি আক্তার। আদালতের নির্দেশে একে অবহেলাজনিত মৃত্যু মামলার সঙ্গে একীভূত করে তদন্ত করে সিআইডি। মামলাটি তদন্ত করে ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এ মামলায় মোট ৫৯৪ জনকে সাক্ষী করা হয়। আদালতে দায়ের করা হত্যা মামলার বাদী শিউলি আক্তার এখন পুলিশের মামলার সাক্ষী। মামলার ৪১ আসামির মধ্যে ভবন মালিক সোহেল রানার বাবা আব্দুল খালেক, অন্য আসামি আবু বক্কর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন মারা যান। তিনজনকে বাদ দিয়ে হত্যা মামলায় এখন আসামির সংখ্যা ৩৮ জন। আসামিদের মধ্যে বর্তমানে কারাগারে আছেন ভবনের মালিক সোহেল রানা। বাকিরা জামিনে ও পলাতক রয়েছেন। ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকার তৎকালীন জেলা ও দায়রা জজ এসএম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু করেন।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, মামলাটিতে অভিযোগ গঠনের পর এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যান আট আসামি। তাদের মধ্যে সাতজনের আবেদন নিষ্পত্তি হয়। তবে আসামি হাজি মোহাম্মদ আলীর পক্ষে করা আবেদনে মামলার বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি মামলার বাদী সাভার থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক ওয়ালী আশরাফের সাক্ষ্য দেওয়ার মাধ্যমে এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়।
বর্তমানে ঢাকার জেলা দায়রা জজ হেলাল উদ্দিনের আদালতে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। এ মামলায় মোট ৫৯৪ জনকে সাক্ষীর মধ্যে প্রায় ৯৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষ। সর্বশেষ গত ১৫ এপ্রিল মামলাটিতে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ধার্য ছিল।ওইদিন কোন সাক্ষী না আসায় আগামী ১৯ মে পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ধার্য করা হয়েছে।
মামলাটি সম্পর্কে ঢাকা জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর মো. ইকবাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামলাটিতে দীর্ঘ সময় লেগে যায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে। এরপর আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশ দিলে আসামিরা সেই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যান। প্রায় ছয় বছর উচ্চ আদালতের আদেশে এ মামলার বিচারকাজ স্থগিত ছিল। সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হওয়ার পর ৯৪ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। সাক্ষী হাজির করতে ১৭ জনের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু করা হয়েছে। আশা করছি সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করে দ্রুতই মামলাটি যুক্তিতর্কের পর্যায়ে নেওয়া হবে। এ বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি নুরুজ্জামান দোলন নামে একজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ১৯ মে দিন ধার্য রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘ সময় আমরা এই মামলার দায়িত্বে ছিলাম না। এতদিন যারা দায়িত্বে ছিলেন তারাই ভালো বলতে পারবেন মামলা নিষ্পত্তিতে কেন এতো দীর্ঘসূত্রিতা। তবে আমরা ধারণা করছি তাদের অবহেলার কারণেই মামলার দীর্ঘসূত্রিতা হয়েছে। আমরা দায়িত্ব পাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। সাক্ষীদের হাজির করতে সমন জারি করেছি। আমরা দ্রুত সময়ে বিচার শেষ করার চেষ্টা করছি। আশা করছি, খুব শীঘ্রই মামলাটির বিচার শেষ হবে এবং ভিকটিমদের পরিবার ন্যায় বিচার পাবেন।
এদিকে মামলায় কারাগারে থাকা রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাকে হাইকোর্ট জামিন দেওয়ার পর রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে জামিন স্থগিতের আবেদন জানায়। ওই আবেদনের ওপর শুনানি শেষে ২০২৪ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ৪ বিচারপতির বেঞ্চ সোহেল রানার জামিন স্থগিত করেন। একই সঙ্গে ছয় মাসের মধ্যে বিচারিক আদালতকে মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। এরপর দ্বিগুণ সময় পার হলেও মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়ে গেছে।
ইমারত আইনে রাজউকের মামলা
আইন না মেনে ভবন নির্মাণের অভিযোগে ওই সময় সোহেল রানাসহ ১৩ জনকে আসামি করে সাভার মডেল থানায় আরেকটি মামলা করেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তৎকালীন (রাজউক) দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল আহমেদ। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলার সাক্ষী করা হয় ১৩০ জনকে। ২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার তৎকালীন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।
এদের মধ্যে আসামি ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলামকে মামলাটি থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত। এছাড়া মামলার আরেক আসামি সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. রেফাতউল্লাহর পক্ষে ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর এক বছরের জন্য মামলার বিচারিক কার্যক্রম স্থগিতের আদেশ দেন উচ্চ আদালত। বর্তমানে মামলাটি ঢাকার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কে এম মহিউদ্দিনের আদালতে বিচারাধীন। সবশেষ গত ৯ এপ্রিল এ মামলায় উচ্চ আদালতের আদেশ দাখিলের জন্য ধার্য ছিল। আসামি পক্ষ তা দাখিল না করায় আগামী ৩১ আগস্ট পুনরায় আদেশ দাখিলের জন্য ধার্য করা হয়েছে। এই মামলায় আসামির সংখ্যা ১৬ জন। সকলেই জামিনে রয়েছেন।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) ইশতিয়াক হোসেন জিপু বলেন, উচ্চ আদালত এক আসামির পক্ষে মামলার কার্যক্রম ছয় মাস স্থগিত করেন। তখনকার সময়ে রাষ্ট্রপক্ষ মামলা এগিয়ে নিতে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। আমরা দায়িত্ব পাওয়ার পর মামলাটি নিয়ে কাজ করছি। আসামিপক্ষ যদি স্থগিতাদেশ বাড়াতে না পারে, তাহলে মামলার বিচার শুরু হবে। আদালত তাদের উচ্চ আদালতের আদেশ দাখিল করতে বলেছেন। তারা দাখিল করতে না পারলে দ্রুত সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে। দীর্ঘ সময় চলে গেছে। আমরা আদালতে সাক্ষী হাজির করে মামলার বিচার দ্রুত শেষ করার উদ্যোগ নেব।
এসব বিষয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী মাসুদ খান খোকন বলেন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনের দুই মামলায় নয় বছর আগে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। কয়েকজন আসামি উচ্চ আদালতে অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আবেদন করেন। ইমারত নির্মাণ আইনের মামলাটিতে এক আসামির পক্ষে স্থগিতাদেশ থাকায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি। মামলা দুইটির বিচার শেষ না হওয়ায় আসামি সোহেল রানা কারামুক্ত হতে পারছেন না।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘ ১২ বছর কারাগারে রয়েছেন সোহেন রানা। এই যে এতগুলো বছর তার জীবন থেকে চলে গেলো, যদি তিনি খালাস পান কে তাকে এই সময়গুলো ফিরিয়ে দেবে। রানা প্লাজার ভবন ধস নিছক একটি দুর্ঘটনা। তাছাড়া ভবনটির প্রকৃত মালিক সোহেল রানাও নন, তার বাবা আব্দুল খালেক। এখানে রানার কোনও হাত নেই। তার মতে আসামি সোহেল রানা বিচারহীনভাবে কারাগারে আটক রয়েছেন বলে জানান তিনি।
ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত দুর্নীতির মামলা
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পরপরই ভবন নির্মাণে দুর্নীতির অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধানে দেখা যায়, রানা প্লাজা নির্মাণে ছয় তলার অনুমোদন থাকলেও আট তলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। এ কারণে ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে আরেকটি মামলা দায়ের করে দুদক। ২০১৪ সালের ১৬ জুলাই রানাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও দুদকের উপপরিচালক মফিদুল ইসলাম। বর্তমানে মামলাটি ঢাকার বিভাগীয় স্পেশাল আদালতে বিচারাধীন।
এ মামলায় অভিযুক্ত আসামিরা হলেন- ভবন মালিক সোহেল রানা, তার বাবা আব্দুল খালেক ওরফে কুলু খালেক, মা মর্জিনা বেগম, সাভার পৌরসভার মেয়র রেফায়েত উল্লাহ, কাউন্সিলর মোহাম্মাদ আলী খান, উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান রাসেল, নিউওয়েব বাটন লিমিটেডের চেয়ারম্যান বজলুস সামাদ আদনান, সাইট ইঞ্জিনিয়ার মো. সারোয়ার কামাল, আমিনুল ইসলাম, নিউওয়েব স্টাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুর রহমান তাপস, ইথার টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান ওরফে আনিসুজ্জামান, সাভার পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায়, প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, গার্মেন্টস ব্যবসায়ী মাহবুবুল আলম, সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, নগর পরিকল্পনাবিদ ফারজানা ইসলাম, নান্টু কন্ট্রাকটার এবং রেজাউল ইসলাম।
জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের মামলা
এই তিন মামলার বাইরে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার বিরুদ্ধে সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলাটিই কেবল নিষ্পত্তি হয়েছে। ২০১৫ সালের ১২ এপ্রিল দুদকের সহকারী পরিচালক মাহবুবুল আলম বাদী হয়ে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা ও তার মা মর্জিনা বেগমের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় রানা প্লাজার নির্মাণের তথ্য গোপন করে দুদকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য দিয়ে ছয় কোটি ৬৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯০০ টাকা জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করার অভিযোগ করা হয়।
২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট এ মামলার রায় ঘোষণা ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬-এর তৎকালীন বিচারক কে এম ইমরুল কায়েস। রায়ে সোহেল রানাকে তিন বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একই মামলায় তার মা মর্জিনা বেগমকেও তিন বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একইসঙ্গে অবৈধভাবে অর্জিত সাভার বাজার রোডের ৬৯/১ বাড়িটির এক-তৃতীয়াংশ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দেন আদালত।
শালবনবার্তা২৪.কম/এআর