ঢাকা ০৩:৫০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মধুপুরে নারী উদ্যোক্তা সুমি, ভার্মি কম্পোস্ট সারে স্বপ্ন ছুঁয়া যার লক্ষ্য

মধুপুর করেসপন্ডেন্ট শালবনবার্তা২৪.কম
  • আপডেট সময় : ১০:২৭:৫২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ১২৯ বার পড়া হয়েছে

অভাবের সংসারে জন্ম নেওয়া পরিবারের বড় মেয়ে সুমি খাতুন। সংসারের হাল ধরতে বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠানে নামমাত্র বেতনে বছরের পর বছর চাকরি করেছেন তিনি। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবে যখন সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত, তখন সুমির জীবনেও নেমে আসে চরম অনিশ্চয়তা। দিশেহারা হয়ে পড়েন—কি করবেন, কোথায় যাবেন, কোন পথে হাঁটবেন—কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছিলেন না তিনি। পরিবারের কষ্টের সেই মুহূর্তগুলো ছিল এমন, যা যে কারও হৃদয়কে ব্যথিত করে তুলবে।
এই কঠিন সময়ে আলোর দিশা দেখান উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন। তিনি সুমিকে ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদনের পরামর্শ দেন এবং তাকে সার্বিক সহযোগিতা করেন। ভার্মি সার উৎপাদন দিয়ে শুরু করেন স্বপ্নের পথে হাঁটা।

মধুপুর উপজেলার ইদিলপুর গ্রামের বাসিন্দা অদম্য এই সুমি। ইটভাটার শ্রমিক বাবা আব্বাস ও গৃহিনী রাশেদা খাতুন দম্পতির বড় মেয়ে তিনি। ছোট বোন রুমি সামনে এসএসসি পরীক্ষার্থী। সংসারের অভাব ঘুঁচাতে তিনি সর্বশেষ এই ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন কাজ শুরু করেন।
ভার্মি কম্পোস্ট সারে মূলত শাকসবজির বর্জ্য, অর্ধপচা গোবরসহ বিভিন্ন জৈব উপাদান উৎকৃষ্ট অনুজীবের মাধ্যমে ফলপ্রসূ সার হিসেবে রূপান্তরিত হয়। এসব উপাদানে কেঁচো ছেড়ে দিলে কেঁচো তা খেয়ে মলত্যাগের মাধ্যমে জৈব সার উৎপাদন করে এবং দ্রুত বংশবিস্তার করে।
করোনার কঠিন সময়ে মাত্র ১০টি রিং ও ৩ কেজি কেঁচো দিয়ে সুমির শুরু করা উদ্যোক্তার পথের সে যাত্রা সুখকর ছিল না । ধার করা টাকা দিয়ে কিনতে হয় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। প্রথম ছয় মাসে তিনি কোনো সার বিক্রি করতে পারেননি। তবুও হাল ছাড়েননি সুমি। ছয় মাসে জমা হয় প্রায় ১৫ মণ সার। উদ্যোক্তা জীবনের শুরুতেই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হলেও তিনি সাহসের সাথে এগিয়েছেন।
পরে তৎকালীন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাকুরা নাম্নীর সহযোগিতায় তার উৎপাদিত সার বাজারজাতের সুযোগ মেলে। বর্তমানে তার খামারে ১২টি সেট (চেম্বার) রয়েছে। শুধু ভার্মি কম্পোস্ট সার নয়—সুমি গড়ে তুলেছেন একটি পুষ্টি বাগান এবং আনারস বাগান। পুষ্টি বাগানে রয়েছে মাল্টা, পেঁপেসহ নানা জাতের ফলগাছ। আনারস বাগানে সাথী ফসল হিসেবে চাষ করেছেন মরিচ, সরিষা ও কলা।
উদ্যোক্তা সুমি খাতুন শুধু সফল কৃষি উদ্যোক্তাই নন, তিনি একজন সচেতন নাগরিকও। তিনি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর ইয়েস গ্রুপের সদস্য। দুর্নীতি বিরোধী সামাজিক আন্দোলন এবং স্থানীয় কয়েকটি রক্তদান সংগঠনের সক্রিয় সদস্য হিসেবেও কাজ করছেন দীর্ঘদিন।
২০২৫ সালে তার জীবনে নেমে আসে আরেক দফা অমানিশা। টিআইবির একটি কর্মসূচি থেকে ফেরার পথে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি গুরুতর আহত হন। একই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তার দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনের দুই সহযোদ্ধা—মধুপুর উপজেলা সনাকের ইয়েস দলনেতা রুহুল আমিন রনি ও ইন্টার্ন রুহুল আমিন। সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় সুমির মেরুদণ্ড ও গুরুত্বপূর্ণ হাড় ভেঙে যায়। দীর্ঘ চিকিৎসার পর বর্তমানে তিনি আবারও নিজের কাজে মনোনিবেশ করছেন।
তার পরিশ্রম ও সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ সুমি খাতুন ২০২৪ সালে উপজেলা পর্যায়ে অর্থনীতিতে স্বাবলম্বী নারী ‘জয়িতা’ পুরস্কার পান। একই বছর জেলা পর্যায়েও অর্থনীতিতে স্বাবলম্বী নারী হিসেবে জয়িতা পুরস্কারে ভূষিত হন। এছাড়া ২০২৪ ও ২০২৫ সালে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ‘ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্প পুরস্কার’ লাভ করেন তিনি। তার সফলতা অর্জনের নেপথ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে ব্লক সুপারভাইজার জেরিনা ইয়াসমিন রিপার।
অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের এই উদ্যমী নারী উদ্যোক্তা বর্তমানে আনন্দ মোহন কলেজে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত। কষ্ট জয়ী সংগ্রামী এই সুমি মধুপুর তথা এ অঞ্চলের অনুকরণীয় মানুষ, একজন তরুণ নারী।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে সুমি খাতুন বলেন,“উপজেলা কৃষি অফিস কিংবা বিভিন্ন প্রকল্প থেকে যদি আরও সহযোগিতা পাই, তাহলে ভার্মি কম্পোস্ট সারের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি এলাকার বেকার যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারব।”

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!

মধুপুরে নারী উদ্যোক্তা সুমি, ভার্মি কম্পোস্ট সারে স্বপ্ন ছুঁয়া যার লক্ষ্য

আপডেট সময় : ১০:২৭:৫২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫

অভাবের সংসারে জন্ম নেওয়া পরিবারের বড় মেয়ে সুমি খাতুন। সংসারের হাল ধরতে বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠানে নামমাত্র বেতনে বছরের পর বছর চাকরি করেছেন তিনি। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবে যখন সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত, তখন সুমির জীবনেও নেমে আসে চরম অনিশ্চয়তা। দিশেহারা হয়ে পড়েন—কি করবেন, কোথায় যাবেন, কোন পথে হাঁটবেন—কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছিলেন না তিনি। পরিবারের কষ্টের সেই মুহূর্তগুলো ছিল এমন, যা যে কারও হৃদয়কে ব্যথিত করে তুলবে।
এই কঠিন সময়ে আলোর দিশা দেখান উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন। তিনি সুমিকে ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদনের পরামর্শ দেন এবং তাকে সার্বিক সহযোগিতা করেন। ভার্মি সার উৎপাদন দিয়ে শুরু করেন স্বপ্নের পথে হাঁটা।

মধুপুর উপজেলার ইদিলপুর গ্রামের বাসিন্দা অদম্য এই সুমি। ইটভাটার শ্রমিক বাবা আব্বাস ও গৃহিনী রাশেদা খাতুন দম্পতির বড় মেয়ে তিনি। ছোট বোন রুমি সামনে এসএসসি পরীক্ষার্থী। সংসারের অভাব ঘুঁচাতে তিনি সর্বশেষ এই ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন কাজ শুরু করেন।
ভার্মি কম্পোস্ট সারে মূলত শাকসবজির বর্জ্য, অর্ধপচা গোবরসহ বিভিন্ন জৈব উপাদান উৎকৃষ্ট অনুজীবের মাধ্যমে ফলপ্রসূ সার হিসেবে রূপান্তরিত হয়। এসব উপাদানে কেঁচো ছেড়ে দিলে কেঁচো তা খেয়ে মলত্যাগের মাধ্যমে জৈব সার উৎপাদন করে এবং দ্রুত বংশবিস্তার করে।
করোনার কঠিন সময়ে মাত্র ১০টি রিং ও ৩ কেজি কেঁচো দিয়ে সুমির শুরু করা উদ্যোক্তার পথের সে যাত্রা সুখকর ছিল না । ধার করা টাকা দিয়ে কিনতে হয় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। প্রথম ছয় মাসে তিনি কোনো সার বিক্রি করতে পারেননি। তবুও হাল ছাড়েননি সুমি। ছয় মাসে জমা হয় প্রায় ১৫ মণ সার। উদ্যোক্তা জীবনের শুরুতেই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হলেও তিনি সাহসের সাথে এগিয়েছেন।
পরে তৎকালীন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাকুরা নাম্নীর সহযোগিতায় তার উৎপাদিত সার বাজারজাতের সুযোগ মেলে। বর্তমানে তার খামারে ১২টি সেট (চেম্বার) রয়েছে। শুধু ভার্মি কম্পোস্ট সার নয়—সুমি গড়ে তুলেছেন একটি পুষ্টি বাগান এবং আনারস বাগান। পুষ্টি বাগানে রয়েছে মাল্টা, পেঁপেসহ নানা জাতের ফলগাছ। আনারস বাগানে সাথী ফসল হিসেবে চাষ করেছেন মরিচ, সরিষা ও কলা।
উদ্যোক্তা সুমি খাতুন শুধু সফল কৃষি উদ্যোক্তাই নন, তিনি একজন সচেতন নাগরিকও। তিনি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর ইয়েস গ্রুপের সদস্য। দুর্নীতি বিরোধী সামাজিক আন্দোলন এবং স্থানীয় কয়েকটি রক্তদান সংগঠনের সক্রিয় সদস্য হিসেবেও কাজ করছেন দীর্ঘদিন।
২০২৫ সালে তার জীবনে নেমে আসে আরেক দফা অমানিশা। টিআইবির একটি কর্মসূচি থেকে ফেরার পথে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি গুরুতর আহত হন। একই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তার দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনের দুই সহযোদ্ধা—মধুপুর উপজেলা সনাকের ইয়েস দলনেতা রুহুল আমিন রনি ও ইন্টার্ন রুহুল আমিন। সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় সুমির মেরুদণ্ড ও গুরুত্বপূর্ণ হাড় ভেঙে যায়। দীর্ঘ চিকিৎসার পর বর্তমানে তিনি আবারও নিজের কাজে মনোনিবেশ করছেন।
তার পরিশ্রম ও সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ সুমি খাতুন ২০২৪ সালে উপজেলা পর্যায়ে অর্থনীতিতে স্বাবলম্বী নারী ‘জয়িতা’ পুরস্কার পান। একই বছর জেলা পর্যায়েও অর্থনীতিতে স্বাবলম্বী নারী হিসেবে জয়িতা পুরস্কারে ভূষিত হন। এছাড়া ২০২৪ ও ২০২৫ সালে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ‘ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্প পুরস্কার’ লাভ করেন তিনি। তার সফলতা অর্জনের নেপথ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে ব্লক সুপারভাইজার জেরিনা ইয়াসমিন রিপার।
অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের এই উদ্যমী নারী উদ্যোক্তা বর্তমানে আনন্দ মোহন কলেজে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত। কষ্ট জয়ী সংগ্রামী এই সুমি মধুপুর তথা এ অঞ্চলের অনুকরণীয় মানুষ, একজন তরুণ নারী।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে সুমি খাতুন বলেন,“উপজেলা কৃষি অফিস কিংবা বিভিন্ন প্রকল্প থেকে যদি আরও সহযোগিতা পাই, তাহলে ভার্মি কম্পোস্ট সারের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি এলাকার বেকার যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারব।”