ঢাকা ০১:১৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৮ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

চক্ষুদানে দৃষ্টি ফেরায় , রক্তদানে বাঁচে প্রাণ

আজ জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস

বিশেষ করেসপন্ডেন্ট শালবনবার্তা২৪.কম
  • আপডেট সময় : ১০:৩৬:৪৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২ নভেম্বর ২০২৫ ১৮৪ বার পড়া হয়েছে

রক্তের ফোঁটা ও চোখের আলোয় জেগে উঠুক মানবতার নতুন আলো । ছবি: আরশেদ আলম (হৃদয়ে মধুপুর ব্লাড সোসাইটি) — রক্তদানের একটি মুহূর্ত

আজ ২ নভেম্বর—জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস। এটি শুধু একটি দিবস নয়, বরং মানবতার উৎসব। যেখানে ‘দান’ মানে কেবল বস্তু নয়, জীবন ও আলো দান। রক্তের ফোঁটায় যেমন কারও জীবন বাঁচে, তেমনি মৃত্যুর পর নিজের চোখ দিয়ে অন্যকে পৃথিবী দেখার সুযোগ করে দেওয়া—দুটিই মানবতার শ্রেষ্ঠ প্রতীক।

রক্ত এমন এক অমূল্য উপাদান যা ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা সম্ভব নয়। মানুষই পারে মানুষকে রক্ত দিতে। দেশে প্রতিবছর প্রায় ১৪ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়, অথচ সংগৃহীত রক্ত তার তুলনায় অনেক কম। দুর্ঘটনা, অস্ত্রোপচার, সন্তান প্রসব কিংবা ক্যানসার চিকিৎসায় প্রতিনিয়ত রক্তের প্রয়োজন হয়।

একজন সুস্থ মানুষ প্রতি তিন থেকে চার মাস পরপর মাত্র ৩০০ মিলিলিটার রক্ত দিতে পারেন—এতে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না। বরং রক্তদানের ফলে শরীরে নতুন রক্তকণিকা তৈরি হয়, রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, নিয়মিত রক্তদাতাদের শরীরে আয়রনের ভারসাম্য বজায় থাকে, রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনা কমে এবং তারা মানসিকভাবে প্রফুল্ল থাকেন। তাই স্বেচ্ছায় রক্তদান শুধু চিকিৎসা সহায়ক কাজ নয়; এটি এক মহৎ মানবিক দান—যার মাধ্যমে একজন মানুষ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে।

রক্তদানের পাশাপাশি মরণোত্তর চক্ষুদানও মানবতার আরেক মহান প্রতীক। দেশে বর্তমানে প্রায় ৭ লাখ মানুষ দৃষ্টিহীন, যাদের অনেকে কর্নিয়া নষ্ট হওয়ার কারণে দেখতে পান না। কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে তাদের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব—শুধু একজন চক্ষুদাতার কারণে। মৃত্যুর ৪ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে দাতার কর্নিয়া সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করা যায় এবং তা অন্যের চোখে প্রতিস্থাপন সম্ভব। এক জোড়া চোখ মানে দুইজন অন্ধ মানুষের পৃথিবী দেখা সম্ভব—মৃত্যুর পরও কারও জীবনে আলো ফিরিয়ে দেওয়া এক অনন্য মানবিক দান।

তবে চক্ষুদাতার সংখ্যা এখনো সীমিত। সমাজে প্রচলিত ভুল ধারণা—যেমন ‘চোখ দান করলে মৃতদেহ অসম্পূর্ণ থাকবে’ বা ‘ধর্মে নিষিদ্ধ’—মানুষকে এখনো পিছিয়ে রাখছে। বাস্তবে এই ধারণার কোনো ভিত্তি নেই। ইসলামসহ কোনো ধর্মই চক্ষুদান বা অঙ্গদান নিষিদ্ধ করেনি। বরং এর মাধ্যমে কারও দৃষ্টি ফিরে এলে তা সওয়াবের কাজ হিসেবেই গণ্য হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রমাণিত, কর্নিয়া সংগ্রহের সময় মৃতদেহের কোনো বিকৃতি ঘটে না এবং চোখের সৌন্দর্যও নষ্ট হয় না।

সরকার ২০১৭ সালে ২ নভেম্বরকে ‘জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস’ ঘোষণা করে। এই দিবসের উদ্দেশ্য—মানুষকে সচেতন করা, রক্তদাতাদের উৎসাহিত করা এবং মৃত্যুর পর চক্ষুদানের প্রতিশ্রুতি বৃদ্ধি করা। দেশের নানা প্রান্তে অসংখ্য তরুণ ও সংগঠন এ উদ্যোগে যুক্ত হয়েছে—বিডি ব্লাড, ব্লাড ম্যান, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, চোখের আলো ফাউন্ডেশন, লাইফসেভারসসহ অনেক সংগঠন নিয়মিত রক্তদান ক্যাম্প, কর্নিয়া সংগ্রহ ও সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে মানবতার ডাক—‘আজ আমি রক্ত দিলাম, আপনি কবে?’—এই আহ্বানই পরিবর্তনের সূচনা করছে। তরুণদের হাত ধরে এই মানবিক আন্দোলন একদিন সবার হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়বে। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে এখন রক্তদাতা খোঁজা আরও সহজ হয়েছে—অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, মোবাইল অ্যাপ বা ফেসবুক গ্রুপে ‘রক্ত চাই’ লিখলেই কয়েক মিনিটের মধ্যে সাড়া মেলে।

একইভাবে চক্ষুদান প্রতিশ্রুতিও এখন ডিজিটালভাবে নিবন্ধন করা যায়। সরকার চাইলে একটি জাতীয় ডেটাবেইস তৈরি করতে পারে, যেখানে রক্তদাতা ও অঙ্গদাতাদের তথ্য সংরক্ষিত থাকবে। এতে জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত সহায়তা পাওয়া সম্ভব হবে।

যা করতে হবে :

  • হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি দপ্তরে নিয়মিত রক্তদান ক্যাম্প আয়োজন করা।
  • ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ত করে চক্ষুদান বিষয়ে সঠিক ধারণা প্রচার করা।
  • গণমাধ্যমে রক্তদাতা ও চক্ষুদাতাদের অনুপ্রেরণাদায়ক গল্প প্রচার করা।
  • মৃত্যুর আগে ‘চক্ষুদান প্রতিশ্রুতি কার্ড’ পূরণে মানুষকে উৎসাহ দেওয়া।
  • জাতীয় পর্যায়ে রক্ত ও অঙ্গদাতা নিবন্ধন কার্যক্রম চালু করা।
  • তরুণ সংগঠনগুলোর জন্য অনুদান ও প্রণোদনা দেওয়া, যাতে তারা নিয়মিত সচেতনতা কার্যক্রম চালাতে পারে।

‘বাঁচার সময় রক্ত দেব, মৃত্যুর পর চোখ দিয়ে যাব পৃথিবীতে আলো ছড়ানোর উত্তরাধিকার।’ মানুষ বাঁচানোই মানবতার শ্রেষ্ঠ দান।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!

চক্ষুদানে দৃষ্টি ফেরায় , রক্তদানে বাঁচে প্রাণ

আজ জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস

আপডেট সময় : ১০:৩৬:৪৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২ নভেম্বর ২০২৫

আজ ২ নভেম্বর—জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস। এটি শুধু একটি দিবস নয়, বরং মানবতার উৎসব। যেখানে ‘দান’ মানে কেবল বস্তু নয়, জীবন ও আলো দান। রক্তের ফোঁটায় যেমন কারও জীবন বাঁচে, তেমনি মৃত্যুর পর নিজের চোখ দিয়ে অন্যকে পৃথিবী দেখার সুযোগ করে দেওয়া—দুটিই মানবতার শ্রেষ্ঠ প্রতীক।

রক্ত এমন এক অমূল্য উপাদান যা ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা সম্ভব নয়। মানুষই পারে মানুষকে রক্ত দিতে। দেশে প্রতিবছর প্রায় ১৪ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়, অথচ সংগৃহীত রক্ত তার তুলনায় অনেক কম। দুর্ঘটনা, অস্ত্রোপচার, সন্তান প্রসব কিংবা ক্যানসার চিকিৎসায় প্রতিনিয়ত রক্তের প্রয়োজন হয়।

একজন সুস্থ মানুষ প্রতি তিন থেকে চার মাস পরপর মাত্র ৩০০ মিলিলিটার রক্ত দিতে পারেন—এতে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না। বরং রক্তদানের ফলে শরীরে নতুন রক্তকণিকা তৈরি হয়, রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, নিয়মিত রক্তদাতাদের শরীরে আয়রনের ভারসাম্য বজায় থাকে, রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনা কমে এবং তারা মানসিকভাবে প্রফুল্ল থাকেন। তাই স্বেচ্ছায় রক্তদান শুধু চিকিৎসা সহায়ক কাজ নয়; এটি এক মহৎ মানবিক দান—যার মাধ্যমে একজন মানুষ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে।

রক্তদানের পাশাপাশি মরণোত্তর চক্ষুদানও মানবতার আরেক মহান প্রতীক। দেশে বর্তমানে প্রায় ৭ লাখ মানুষ দৃষ্টিহীন, যাদের অনেকে কর্নিয়া নষ্ট হওয়ার কারণে দেখতে পান না। কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে তাদের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব—শুধু একজন চক্ষুদাতার কারণে। মৃত্যুর ৪ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে দাতার কর্নিয়া সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করা যায় এবং তা অন্যের চোখে প্রতিস্থাপন সম্ভব। এক জোড়া চোখ মানে দুইজন অন্ধ মানুষের পৃথিবী দেখা সম্ভব—মৃত্যুর পরও কারও জীবনে আলো ফিরিয়ে দেওয়া এক অনন্য মানবিক দান।

তবে চক্ষুদাতার সংখ্যা এখনো সীমিত। সমাজে প্রচলিত ভুল ধারণা—যেমন ‘চোখ দান করলে মৃতদেহ অসম্পূর্ণ থাকবে’ বা ‘ধর্মে নিষিদ্ধ’—মানুষকে এখনো পিছিয়ে রাখছে। বাস্তবে এই ধারণার কোনো ভিত্তি নেই। ইসলামসহ কোনো ধর্মই চক্ষুদান বা অঙ্গদান নিষিদ্ধ করেনি। বরং এর মাধ্যমে কারও দৃষ্টি ফিরে এলে তা সওয়াবের কাজ হিসেবেই গণ্য হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রমাণিত, কর্নিয়া সংগ্রহের সময় মৃতদেহের কোনো বিকৃতি ঘটে না এবং চোখের সৌন্দর্যও নষ্ট হয় না।

সরকার ২০১৭ সালে ২ নভেম্বরকে ‘জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস’ ঘোষণা করে। এই দিবসের উদ্দেশ্য—মানুষকে সচেতন করা, রক্তদাতাদের উৎসাহিত করা এবং মৃত্যুর পর চক্ষুদানের প্রতিশ্রুতি বৃদ্ধি করা। দেশের নানা প্রান্তে অসংখ্য তরুণ ও সংগঠন এ উদ্যোগে যুক্ত হয়েছে—বিডি ব্লাড, ব্লাড ম্যান, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, চোখের আলো ফাউন্ডেশন, লাইফসেভারসসহ অনেক সংগঠন নিয়মিত রক্তদান ক্যাম্প, কর্নিয়া সংগ্রহ ও সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে মানবতার ডাক—‘আজ আমি রক্ত দিলাম, আপনি কবে?’—এই আহ্বানই পরিবর্তনের সূচনা করছে। তরুণদের হাত ধরে এই মানবিক আন্দোলন একদিন সবার হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়বে। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে এখন রক্তদাতা খোঁজা আরও সহজ হয়েছে—অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, মোবাইল অ্যাপ বা ফেসবুক গ্রুপে ‘রক্ত চাই’ লিখলেই কয়েক মিনিটের মধ্যে সাড়া মেলে।

একইভাবে চক্ষুদান প্রতিশ্রুতিও এখন ডিজিটালভাবে নিবন্ধন করা যায়। সরকার চাইলে একটি জাতীয় ডেটাবেইস তৈরি করতে পারে, যেখানে রক্তদাতা ও অঙ্গদাতাদের তথ্য সংরক্ষিত থাকবে। এতে জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত সহায়তা পাওয়া সম্ভব হবে।

যা করতে হবে :

  • হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি দপ্তরে নিয়মিত রক্তদান ক্যাম্প আয়োজন করা।
  • ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ত করে চক্ষুদান বিষয়ে সঠিক ধারণা প্রচার করা।
  • গণমাধ্যমে রক্তদাতা ও চক্ষুদাতাদের অনুপ্রেরণাদায়ক গল্প প্রচার করা।
  • মৃত্যুর আগে ‘চক্ষুদান প্রতিশ্রুতি কার্ড’ পূরণে মানুষকে উৎসাহ দেওয়া।
  • জাতীয় পর্যায়ে রক্ত ও অঙ্গদাতা নিবন্ধন কার্যক্রম চালু করা।
  • তরুণ সংগঠনগুলোর জন্য অনুদান ও প্রণোদনা দেওয়া, যাতে তারা নিয়মিত সচেতনতা কার্যক্রম চালাতে পারে।

‘বাঁচার সময় রক্ত দেব, মৃত্যুর পর চোখ দিয়ে যাব পৃথিবীতে আলো ছড়ানোর উত্তরাধিকার।’ মানুষ বাঁচানোই মানবতার শ্রেষ্ঠ দান।